হিন্দু উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর (দায়ভাগ মতবাদ)
হিন্দু উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটরটি বাংলাদেশের প্রচলিত দায়ভাগ মতবাদ অনুযায়ী হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকারের একটি সরলীকৃত হিসাব প্রদান করে।
গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য: হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রথার উপর নির্ভরশীল। এই ক্যালকুলেটরটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ ধারণা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং এটি কোনো আইনি পরামর্শ নয়। সঠিক আইনি পরামর্শের জন্য একজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করুন।
মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ:
উত্তরাধিকারের ফলাফল:
হিন্দু উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর সম্পর্কে বিস্তারিত
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন একটি জটিল এবং বহুস্তরীয় বিষয়, যা মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহাসিক প্রথা এবং কিছু বিধিবদ্ধ আইনের সমন্বয়ে গঠিত । দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.৯৫% হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এবং তাদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো দায়ভাগ মতবাদ (Dayabhaga School) দ্বারা পরিচালিত হয় । এই মতবাদটি জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’ গ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত, যা মূলত উত্তরাধিকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে ।
ঐতিহাসিকভাবে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসা আইনগুলোই বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে । উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩৭ সালের হিন্দু মহিলা সম্পত্তি অধিকার আইন (Hindu Women’s Right to Property Act) এখনও কার্যকর রয়েছে, যা নারীর উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা তৈরি করে । এই আইনগুলো সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারেনি এবং আধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, যার ফলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে । বাংলাদেশের সংবিধান লিঙ্গ, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য নিষিদ্ধ করলেও, উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে এই নীতি পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না । এই প্রেক্ষাপটে, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও আইনি দাবিতে পরিণত হয়েছে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মূল ভিত্তি: দায়ভাগ মতবাদ
বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মূলত দায়ভাগ মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কিছু রাজ্যেও প্রচলিত । এই মতবাদটি মিতাক্ষরা মতবাদ থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন।
দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের পার্থক্য
দায়ভাগ এবং মিতাক্ষরা মতবাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় পার্থক্যটি সম্পত্তির মালিকানা এবং উত্তরাধিকারের সময়কালকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় ।
১. সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের সময়কাল:
- দায়ভাগ মতবাদ: এই মতবাদ অনুসারে, পুত্র পিতার পৈতৃক সম্পত্তিতে পিতার জীবদ্দশায় কোনো অধিকার পায় না। পিতার মৃত্যুর পরেই কেবল পুত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় । পিতা তার জীবদ্দশায় পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে যা খুশি তাই করার ক্ষমতা রাখেন, এমনকি তিনি চাইলে তা হস্তান্তরও করতে পারেন । দায়ভাগ মতে, সম্পত্তি সাম্প্রদায়িকভাবে পরিবারের মালিকানাধীন নয়, বরং পিতার মৃত্যুর পর প্রত্যেক ছেলে তার সম্পত্তির অংশ নিয়ে যা খুশি করার ক্ষমতা রাখে 。
- মিতাক্ষরা মতবাদ: এর বিপরীতে, মিতাক্ষরা মতে, জন্মমাত্রই পুত্র পূর্বপুরুষের সম্পদে পিতার সমান অংশীদার হয় । এই ব্যবস্থায়, পৈতৃক সম্পত্তিকে যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি (Coparcenary Property) হিসেবে দেখা হয়, যেখানে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা জন্মগতভাবে অধিকার লাভ করে ।
২. ধর্মীয় কার্যকারিতা (Religious Efficacy) বনাম নৈকট্য (Propinquity) নীতি:
- দায়ভাগ মতবাদ: দায়ভাগ মতবাদের উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি হলো ‘ধর্মীয় কার্যকারিতা’ (Doctrine of Religious Efficacy) । এই নীতি অনুসারে, মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণের জন্য পিণ্ডদান বা শ্রাদ্ধ করার ক্ষমতা যার আছে, তিনিই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য । এই আধ্যাত্মিক নীতির ওপর ভিত্তি করেই উত্তরাধিকারীদের ক্রম নির্ধারিত হয়।
- মিতাক্ষরা মতবাদ: মিতাক্ষরা মতবাদে উত্তরাধিকারের মূলনীতি হলো ‘নৈকট্য’ (Propinquity), অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সাথে রক্তের সম্পর্কের নৈকট্যের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয় ।
৩. যৌথ পারিবারিক সম্পত্তি ও কোপারসেনার ধারণা:
- দায়ভাগ মতবাদ: দায়ভাগ ব্যবস্থায় যৌথ পারিবারিক সম্পত্তির ধারণাটি মিতাক্ষরার মতো কঠোর নয় । এখানে পরিবারের সদস্য তার অংশীদারিত্বকে ‘প্রায়-একক’ (quasi-severalty) হিসেবে ধারণ করে এবং পিতার জীবদ্দশায় পুত্রের কোনো অন্তর্নিহিত অধিকার থাকে না । পিতা পরিবারের সকল সম্পত্তির একক নিয়ন্ত্রক এবং তিনি পৈতৃক ও স্ব-অর্জিত উভয় সম্পত্তির উপর সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন ।
- মিতাক্ষরা মতবাদ: মিতাক্ষরা ব্যবস্থায় ‘কোপারসেনার’ (Coparcener) বা সহ-অংশীদাররা জন্মগতভাবে পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করে । পরিবারের প্রধান (কর্তা) সম্পত্তি পরিচালনা করলেও, সকল কোপারসেনারের সম্মতি ছাড়া তা হস্তান্তর করতে পারেন না ।
বাংলাদেশে দায়ভাগ মতবাদের প্রয়োগ
বাংলাদেশে দায়ভাগ মতবাদ অনুসরণ করা হয়, যেখানে মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণের জন্য পিণ্ডদান করার অধিকারী ব্যক্তিরাই সপিণ্ড এবং যোগ্য উত্তরাধিকারী বলে বিবেচিত হন ।
১. পিণ্ডদান, পিণ্ডলেপ ও জলদান নীতির ভূমিকা: হিন্দুধর্মাবলম্বী কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার আত্মার সদ্গতির জন্য শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হয়, যার তিনটি ধাপ রয়েছে: পিণ্ডদান, পিণ্ডলেপ এবং জলদান । এই ধর্মীয় কার্যকারিতার ক্ষমতা উত্তরাধিকার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
২. সপিণ্ড, সকুল্য, ও সমনোদকের ধারণা ও অগ্রাধিকার:
- সপিণ্ড (Sapinda): দায়ভাগ মতে, সপিণ্ড বলতে তাদের বোঝায় যারা মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণে পিণ্ডদানের অধিকারী । এরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির প্রধানতম অধিকারী । সপিণ্ডদের মধ্যে রয়েছে পিতৃকুল ও মাতৃকুলের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ, পুত্র ও কন্যার অধস্তন তিন পুরুষ, এবং ঊর্ধ্বতন মাতৃ ও পিতৃকুলের ছয় পুরুষ । পাঁচজন নারী সপিণ্ডও রয়েছেন: বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা (পিতামহী) এবং পিতার পিতার মাতা (প্রপিতামহী) । পিতৃকুলের সপিণ্ডরা জীবিত থাকলে মাতৃকুলের সপিণ্ডরা সাধারণত সম্পত্তি পান না ।
- সকুল্য (Sakulya): সকুল্যরা সকলেই পুরুষ এবং তারা পিণ্ডলেপ (smearing of rice balls) প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্কিত । এরা চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পিতৃকুলীয় পুরুষ পূর্বপুরুষ এবং তাদের পুরুষ বংশধরদের অন্তর্ভুক্ত ।
- সমনোদক (Samanodaka): সমনোদকরাও সকলেই পুরুষ এবং তারা জলদান (libations of water) প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্কিত । এরা আরও দূরবর্তী আত্মীয়দের অন্তর্ভুক্ত, যারা সকুল্যদের পরে উত্তরাধিকারী হন ।
- উত্তরাধিকারের ক্রম অনুসারে, সপিণ্ডরা সকুল্যদের আগে এবং সকুল্যরা সমনোদকদের আগে সম্পত্তি পায় ।
উত্তরাধিকারীদের শ্রেণীবিভাগ ও সম্পত্তির অংশ নির্ধারণ
হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারীদের শ্রেণীবিভাগ এবং সম্পত্তির অংশ নির্ধারণের নিয়মগুলো দায়ভাগ মতবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা পুরুষ ও নারী উভয় উত্তরাধিকারীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান রাখে।
ক. পুরুষ উত্তরাধিকারী
পুরুষ উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রে পুত্রের অধিকার সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়।
১. পুত্রের অগ্রাধিকার ও প্রতিনিধিত্বের ধারণা:
- মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে সবার আগে পুত্র, পুত্রের অনুপস্থিতিতে পৌত্র (পুত্রের পুত্র), এবং পুত্র ও পৌত্রের অনুপস্থিতিতে প্রপ্রৌত্র (পুত্রের পুত্রের পুত্র) সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন । এর কারণ হলো, পুত্র তার পিতার, পৌত্র তার পিতার এবং প্রপৌত্র তার পিতা ও পিতামহের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং মৃত ব্যক্তির আত্মার সদ্গতির জন্য পিণ্ডদানের অধিকারী হন ।
- যদি একাধিক পুত্র থাকে, তবে তারা প্রত্যেকে সমান অংশ পায় । উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তির ৩ পুত্র থাকে, তবে প্রত্যেকে ১/৩ অংশ করে সম্পত্তি পাবে; যদি ৫ পুত্র থাকে, তবে প্রত্যেকে ১/৫ অংশ পাবে ।
- যদি প্রথম সারির (পুত্র, পৌত্র, প্রপ্রৌত্র) কেউ জীবিত না থাকে, তবেই পর্যায়ক্রমে নিচের ক্রমের দিকে উত্তরাধিকার বর্তায় ।
২. দত্তক পুত্রের অধিকার: হিন্দু আইনে দত্তক পুত্র গ্রহণের বিধান রয়েছে । বাংলাদেশে দত্তক পুত্র সাধারণ পুত্রের ন্যায় সম্পত্তি পায় । তবে, দত্তক পুত্র গ্রহণ করার পর যদি স্বাভাবিক পুত্র জন্মগ্রহণ করে, তবে দত্তক পুত্র সমুদয় সম্পত্তির ১/৩ অংশ পাবে এবং স্বাভাবিক পুত্র বাকি ২/৩ অংশ পাবে ।
৩. অন্যান্য পুরুষ উত্তরাধিকারী: পুত্র, পৌত্র, প্রপ্রৌত্র, এবং বিধবা স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অন্যান্য পুরুষ উত্তরাধিকারীরা ক্রমানুসারে সম্পত্তি পান । এদের মধ্যে পিতা, ভাই, চাচার ছেলে, ভাইয়ের পুত্র, ভাইয়ের পুত্রের পুত্র, বোনের পুত্র, পিতামহ, পিতামহী, পিতার ভাই ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ।
খ. নারী উত্তরাধিকারী
বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকার অত্যন্ত সীমিত এবং প্রায়শই বৈষম্যমূলক ।
১. বিধবা স্ত্রীর অধিকার ও সীমাবদ্ধতা: জীবনস্বত্ব ও আইনি প্রয়োজনীয়তা:
- স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন । ১৯৩৭ সালের হিন্দু মহিলা সম্পত্তি অধিকার আইন অনুসারে, বিধবা স্ত্রী তার জীবদ্দশায় মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সমান ‘জীবনস্বত্ব’ (life interest) পান ।
- এই জীবনস্বত্ব মানে হলো, বিধবা নারী তার জীবদ্দশায় স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন, তবে তিনি এটি বিক্রি, হস্তান্তর বা এমনকি নিজের সন্তানদেরও দান করতে পারবেন না । তার মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি মৃত স্বামীর পুরুষ উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরে যায় (‘reversionary interest’) ।
- তবে, কিছু ‘আইনি প্রয়োজনীয়তা’ (legal necessity) থাকলে বিধবা নারী সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন । এর মধ্যে রয়েছে মৃত ব্যক্তির সৎকার, ঋণ পরিশোধ, আত্মার শান্তির জন্য ধর্মীয় কাজ, সন্তানদের ভরণপোষণ বা বিবাহ খরচ, এবং মৃত ব্যক্তির ব্যবসা চালু রাখার খরচ ।
- ২০২০ সালের একটি যুগান্তকারী হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে যে হিন্দু বিধবা নারীরা স্বামীর কৃষি ও অকৃষি উভয় সম্পত্তির ভাগ পাবেন এবং আইনি প্রয়োজনে তা বিক্রিও করতে পারবেন । এই রায়টি ১৯৩৭ সালের আইনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বিধবাদের অধিকারকে আরও শক্তিশালী করেছে ।
২. কন্যার অধিকার ও বঞ্চনার কারণ:
- দায়ভাগ আইন অনুসারে, পুত্রের উপস্থিতিতে হিন্দু কন্যা পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন । যদি পুত্র না থাকে, তবে অবিবাহিতা কন্যা এবং পুত্রবতী কন্যারা জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকার পান ।
- তবে, বন্ধ্যা, বিবাহিতা কন্যা বা বিধবা কন্যা এবং কন্যা জন্মদানকারী কন্যারা (যাদের পুত্র সন্তান নেই) সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন । অর্থাৎ, কন্যার অধিকার নির্ভর করে পুত্র থাকা বা না থাকার ওপর ।
- যদি কোনো হিন্দু লোক ধর্মান্তরিত হয়, তবে সে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় । হত্যাকারী এবং তার ওয়ারিশও মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ।
৩. মাতার অধিকার: মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, কন্যার পুত্র এবং পিতা জীবিত থাকলে মাতা সাধারণত সম্পত্তি পান না । তবে, দায়ভাগ মতে, মাতা পাঁচজন স্বীকৃত নারী উত্তরাধিকারীর একজন ।
৪. পিতামহী ও প্রপিতামহীর অধিকার: পিতামহী (পিতার মাতা) এবং প্রপিতামহী (পিতার পিতার মাতা) দায়ভাগ মতবাদের অধীনে স্বীকৃত পাঁচজন নারী উত্তরাধিকারীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত । তাদের অধিকারও বিধবাদের মতো জীবনস্বত্বে সীমাবদ্ধ থাকে ।
গ. স্ত্রীধন ও নারীর সম্পত্তি
হিন্দু আইনে নারীর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ‘স্ত্রীধন’ (Stridhan) এবং ‘নারীর সম্পত্তি’ (Woman’s Estate) এর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যা নারীর মালিকানা অধিকার এবং সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করে ।
১. স্ত্রীধনের সংজ্ঞা ও নারীর পূর্ণ অধিকার:
- স্ত্রীধন হলো এমন সম্পত্তি যার উপর নারীর সম্পূর্ণ মালিকানা অধিকার থাকে । নারী তার ইচ্ছানুসারে এই সম্পত্তি বিক্রি, উইল বা অন্য যেকোনো উপায়ে হস্তান্তর করতে পারেন, এবং এর জন্য কারো অনুমতি বা সম্মতির প্রয়োজন হয় না ।
- স্ত্রীধন সাধারণত বিবাহকালীন সময়ে পিতা বা স্বামীর পরিবার থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তিকে বোঝায় । অবিবাহিতা বা বিধবা নারী উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সম্পত্তি অর্জন করলে সেটিও স্ত্রীধন হিসেবে গণ্য হয় । স্ত্রীধন থেকে অর্জিত যেকোনো আয় বা নতুন সম্পত্তিও স্ত্রীধন হিসেবে বিবেচিত হয়।
- স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্ত্রীধন তার নিজস্ব উত্তরাধিকারীদের কাছে বর্তায় ।
২. নারীর সম্পত্তির (Woman’s Estate) সীমাবদ্ধতা ও হস্তান্তর:
- ‘নারীর সম্পত্তি’ হলো এমন সম্পত্তি যার উপর নারীর পূর্ণ মালিকানা অধিকার থাকে না । এই ধরনের সম্পত্তি সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় । বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতামহী, এবং প্রপিতামহী এই শ্রেণীর সম্পত্তির অধিকারী হন ।
- নারী এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারলেও, আইনি প্রয়োজন ছাড়া তা বিক্রি বা উইল করতে পারেন না । তার মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি মূল মালিকের (যিনি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছে) পুরুষ উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরে যায় ।
৩. স্ত্রীধন বনাম যৌতুক বিতর্ক: আধুনিক যুগে স্ত্রীধনকে অনেক সময় ‘যৌতুক’ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, যা আইনত নিষিদ্ধ ও অবৈধ । স্ত্রীধনের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে দাতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, এর মাধ্যমে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
হিন্দু উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চনা ও অযোগ্যতা
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে কিছু নির্দিষ্ট কারণে ব্যক্তি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত বা অযোগ্য ঘোষিত হতে পারে।
- শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা: অন্ধ, বধির, মূক, অঙ্গহীন, পুরুষত্বহীন এবং হাবাগোবা পুরুষ ও মহিলাগণ হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হন । এমনকি দূরারোগ্য কুষ্ঠ-ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিগণও উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত । তবে, আধুনিক আইনে ব্যাধি, বিকৃতি বা বিকলাঙ্গতার কারণে কাউকে উত্তরাধিকার থেকে অযোগ্য করা হয় না । খসড়া আইনে প্রতিবন্ধী এবং হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) সন্তানরাও প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ।
- ধর্মান্তরকরণ: কোনো হিন্দু লোক ধর্মান্তরিত হলে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয় । যদি কোনো হিন্দু এই আইনের প্রারম্ভের পূর্বে বা পরে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু থাকতে বিরত হয়, সেক্ষেত্রে ঐরূপ ধর্মান্তরণের পরে জাত তার সন্তানগণ এবং তাদের বংশজগণ তাদের হিন্দু আত্মীয়গণের মধ্যে কাহারও সম্পত্তি দায়াধিকারসূত্রে পাইবার অযোগ্য হইবে, যদি না উত্তরাধিকার আরম্ভ হইবার সময়ে ঐ সন্তান বা বংশজগণ হিন্দু থাকে ।
- হত্যাকারী ও তার ওয়ারিশ: হত্যাকারী এবং তার ওয়ারিশ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে । যে ব্যক্তি খুন করে অথবা খুনের কার্যে অপসহায়তা করে সে, যাহাকে খুন করা হইয়াছে তাহার সম্পত্তি, অথবা যে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অগ্রসারণের জন্য সে খুন করিয়াছে বা খুনের কার্যে অপসহায়তা করিয়াছে সেরূপ অন্য কোন সম্পত্তি, দায়াধিকার সূত্রে পাইবার অযোগ্য হইবে ।
- অসতীত্ব ও পুনর্বিবাহ: স্বামী অসতী স্ত্রী রেখে মারা গেলে, সেই অসতী স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি পাবে না । তবে বিধবা স্ত্রী আইন সঙ্গতভাবে সম্পত্তি পাওয়ার পর অসতী হলে প্রাপ্ত সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে না । অসতীত্বের কারণে মাতাও উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয় । পুনর্বিবাহ করলে বিধবা নারী তার পূর্বের স্বামীর নিকট থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি মৃত স্বামীর জীবিত অন্যান্য ওয়ারিশের নিকট ছেড়ে দিতে হয় । তবে, একটি সাম্প্রতিক রায়ে বলা হয়েছে যে, একই বর্ণের মধ্যে পুনর্বিবাহ করলে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অধিকার বাতিল নাও হতে পারে, যদি প্রথাগত প্রমাণ থাকে ।
- সন্ন্যাস: হিন্দু আইনে সন্ন্যাসী উত্তরাধিকার হয় না। সন্ন্যাসীকে সংসার ত্যাগী হিসাবে মৃত ধরা হয় ।
- উইল দ্বারা বঞ্চনা: একজন হিন্দু ব্যক্তি উইল (Will) দ্বারা তার স্ব-অর্জিত সম্পত্তি (self-acquired property) থেকে আইনি উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করতে পারেন । তবে, বিধবা স্ত্রীর ভরণপোষণের অধিকার বা পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার জন্মগত অধিকার (যদি থাকে) উইল দ্বারা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা যায় না ।
৫. আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও বিতর্ক
বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, যা মূলত দায়ভাগ মতবাদ দ্বারা পরিচালিত, পুরুষ ও নারীর সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও প্রথাগত বৈষম্য ধারণ করে। তবে এটা নিজ নিজ ধর্মের ব্যাপার। ধর্ম মানলে এটা হিন্দু মেয়েদের মেনে নেওয়া কোনো ব্যাপার না। যদিও বিধবা নারীদের কৃষি জমিতে উত্তরাধিকারের বিষয়ে হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় এসেছে, তবে কন্যার অধিকার এবং সম্পত্তির উপর নারীর পূর্ণ মালিকানার বিষয়টি এখনও সীমিত।
বি.দ্র: উপরের লেখাটি অনলাইনের বিভিন্ন আর্টিকেল ঘেটে লেখা হয়েছে। শুধুমাত্র হিন্দু উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর তৈরি ও এর বিস্তারিত জানানোর জন্য। তাছাড়া এখানে কোনো ধর্মিও বিষয় তুলে ধরা হয়টি। কোনো অসংগতি থাকলে দয়া করে কমেন্টে বা আমাদের মেইলে জানাবেন। দ্রুত তা ঠিক করে দেওয়া হবে।